![]() |
| when sunset arise, beloved home sunshine |
কোন এক বসন্তের বৈকাল। গরু বাছুর ভেড়ার গাধার পাল ছুটছে গৃহের তরে। নখের খুড়ে উড়ছে বালি যেন মৃদু হাওয়ার পরে। দূরে আকাশে কিচিমিচি পাখির পাল চলেছে বাসার তরে। সূর্যাস্তের রাঙা আলোয় দূরে সরু খালের জল হয়েছে রক্তাভ। পরিশ্রান্ত রাখালের দল ছোট বড়ো নির্বিশেষে ফিরছে গৃহের পানে আপনজনের কাছে। মুখে এক তৃপ্তি আজকের দিনটা কেটে গেল; মনে এক শান্তির কামনা, ফিরে ভালোবাসার মানুষের কাছে যাব। তবুও কপালে কোথাও একটা চিন্তার ভাঁজ কাল কেমন যাবে।
দিগন্তে যখন সবাই সুখের বন্ধনে বন্ধিত হতে যাচ্ছে, খুড়ের তরে উড়িত বালির পরে মৃদু বাতাসের তরে একটি শুকনো আম পাতা তার অন্তিম মুহূর্তের মুহূর্ত গুনছে। আজ তার শেষ দিন। কাল আর সে থাকবেনা। কাল সে এই বালি মাটির পরে মিশে যাবে। টুকরো টুকরো হয়ে হারিয়ে যাবে এই ধরণীর পরে। আজ তাই তার একটাই কথা, সেদিন আর আসবে না আর পড়বে না মনে।
নিরাকার দুনিয়ায়, অদৃশ্য প্রাণের তরে হয়েছে তার সাথী এক আত্মার। সে ছিল কভু আজ নেই। এই পাতার এক মাত্র সাথী এক মাত্র সাক্ষী যে দেখেছে তার যৌবন, দেখেছে তার গ্লানী, দেখেছে তার হাসি খুশিতে ভরা দিন। সেও তো আজ হয়ে যাবে একা। তার দুঃখের সাথী তো আজ হারিয়ে যাবে। সবার কাছে সে শুনবে তার দুর্বলতার পরিহাস, তার স্বল্প চিন্তার দুরাবাস, তার অলসতার হাঁসফাঁস, তার মুর্খামির নিরাবাস। আজ তাই আর একবার পাড়ি দিল সে সময়ে যে সময় আজ নেই, ছিল একদিন। হারিয়েছি আমরাই দুর্বলতার পরিহাসে।
একটি জঙ্গল ছিল। জঙ্গলে অনেক গাছ। ছোট বড়। দূরে মাঠ আছে। কাছে একটা খাল কাটা সরু নদী আছে। পরিষ্কার জল। ঘাস আছে। হয়তো দূরে পশ্চিমে একটা গ্রাম আছে। ছোট ছোট অস্পষ্ট তার ছবি। তবে বিশ্বাস আছে যে গ্রাম আছে। কিছু রাখাল সর্বদা আসে এই জঙ্গলে। এখানে বড় বড় প্রাচীন গাছ, বট, শিমুল, আম, ইত্যাদি গাছের সমাগম। আছে অনেক রকম ফলের গাছ। রাখালের দল তাদের পশুদের ছেড়ে এখানে বিভিন্ন গাছের তলায় একটু জিরিয়ে নেয়। কেউ করে নেশা, কেউ বাঁধে গান, কেউ দেখে স্বপ্ন, কেউ ঘরের পাঠানো খাবারে দেয় চুম্বন। এই তো আমাদের হাসিখুশির জীবন। এমনই তো ভালো বলল এক মিষ্ট সবুজ আম পাতা তার গাছকে। বলল আমাদের দেওয়া ফল কাঠ যদি কাউকে খুশি দেয় তো ক্ষতি কি। গাছ বলল “তুই ছোটো দুনিয়া দেখিসনি। আমি দূরে দেখতে পাই, যেখানে তুই দেখতে পাসনা। অনেক অনেক জঙ্গল ছিল, সব কমেছে, কোথাও হয়েছে মাঠ, কোথাও উঠেছে সিমেন্টের প্রাচীর। ভয় হয় আর কত দিন রইবো আমরা। না পারিব পালাতে না পারিব বাঁচাতে, না দেখিবে কেউ আমাদের ক্রন্দন, সবই হবে শেষ”। পাতা কহে “করিও না চিন্তা, দেখবে আজ আমরা যাদের দেখছি, যাদের আমারা খুশি দিচ্ছি, তারা ঠিক আমাদের দেখবে”।
এই করে কাটে জঙ্গলের এক কোণে এক বৃদ্ধ আম গাছের। কিছু সময়ের পর লোক আসা বন্ধ হতে থাকে, হারাতে থাকে প্রাণবন্ত জঙ্গলের অট্টহাসি। গাছের তো হল চিন্তা, হলটা কি? লোকগুলোর কোনও অসুখ করলো না তো! সবাই একসাথে কি করে আসা বন্ধ করলো। জানতে পারল বেশ কিছু দিনের পর দুটি লোকের কথায়।
বাবু: “দেখে যা জায়গাটা কেমন?”
রাখাল: “ভালো স্যার। কয়েক বিঘা হবে।“
বাবু: “চিন্তা নেই তো তোর। তোর জন্য একটা AC ঘর আর আমার ফ্যাক্টরিতে চাকরি পাকা। তবে যত দিন না হচ্ছে তুই এই মানুষ খেকো বাঘের কথা চালিয়ে যা, আর এই জঙ্গলের ফল বেচে তোর পশুদের চরা। লাভ কর। আমি আছি।“
রাখাল: “ধন্যবাদ স্যার। আমি ঠিক তাই করবো।“
গাছ বুঝে গেল মানুষের পশু লোভী চরিত্রটাকে। যেটা তার চিন্তা, যে কথা সে তার পাতা ফলেদের শোনায় আজ তার আগমনের নির্ঘণ্ট বেজে উঠল। গাছের পাতা চাইল তার সর্ব শক্তি দিয়ে চিৎকার করে সবাইকে বলতে, “মিথ্যা মিথ্যা, বাঘ নেই, এসেছে কিছু মানুষরূপী নেকড়ে”। কিন্তু সে কি বা বলবে কি বা শোনাবে। কেউ বলেছে আছে গাছের প্রাণ কিন্তু নেই এমন কোন সাধন যাতে গাছ ব্যক্ত করে তার কথা। কিন্তু এ তো এক দয়া রূপী বৃক্ষ। তার কাছে শত্রু বন্ধু সব এক। সবাইকেই দেয় সে একই রকম ভালোবাসা।
![]() |
| In the middle of nowhere, a friend make you believe, you are in somewhere |
ঐ রাখালটি তার ভেড়ার পাল নিয়ে আসতে লাগল জঙ্গলে। এখন পুরো জঙ্গলটাই তার। সে ভেড়া চড়ায়, ফল খায়, আর এই আম গাছের তলায় একটু জিরিয়ে নেয়। দেখে স্বপ্ন ফ্যাক্টরিতে কাজ করার। সুট বুট পরে বাবুর সঙ্গে সঙ্গে চলার। এমন করে কিছু দিন কাটার পর একদিন আরও এক বন্ধু এলো গাছের দুয়ারে বন্ধু হতে। একটি অল্প বয়সী মেয়ে। হয়তো পনের ষোলোর বয়সের। সে হয়তো কথা বলতে পারেনা, কেননা ইশারায় তো কইল “আমি কি কিছু আম পাড়তে পারি? বেচে কিছু পয়সা পেলে আমার পরিবারকে খাওয়াইতে পারিব”। রাখালটাকে মেয়েটি ভাবতো গাছের মালিক। রাখালটার খুব ভালো লাগলো মেয়েটিকে। মেয়েটির কথায় রাজি হয়ে গেল। মেয়েটি গাছে উঠতে খুব ভালো পারতো। উঁচু উঁচু মগ ডালে নিমেষে উঠে যেত। রাখালটি গাছে উঠতে জানলেও এত উঁচুতে উঠতে জানতো না। মেয়েটিকে বলল সে, “আমায় শেখাবে গাছের মগডালে চড়া”। মেয়েটি মৃদু হেসে ঘাড় নেড়ে সম্মতি জানালো। মেয়েটি রোজ আসতো, আম পাড়তো, গাছে চড়া শেখাত, আর একটু করে দই প্রতিদিন রাখালটার জন্য আনত। রাখালটাও বুঝল মেয়েটি তাকে ভালবাসে। প্রতিদিন দুপুরে যখন পড়ন্ত রোদে লোকে ঘরের ছায়ার তরে জিরন দিয়েছে, তখন জঙ্গলের এক কোণে আম গাছের তলে ছায়ার পরে কিচিমিচি পাখি হনুমানদের শব্দের সাথে মেয়েটির মৃদু কণ্ঠ্যের সুরে বেজে উঠত রাখালের গলা। উঠত মধুর ধ্বনি গাইত গান। আম গাছটিও খুশিতে মেলত ডানা। পাতাগুলিও ঝর্ঝরিয়ে দিত মেলে পাখনা।
গাছ জানতো নিয়তি দিন দিন আসছে ঘনিয়ে ঐ দূর আকাশ হতে। তবুও স্বল্প জীবনে যতটুকু খুশি মেলে সে সবটাই পেতে চায়। তাই উঁচু আরও উঁচুতে ফোটাতে থাকে ফল। যাতে এই দুই বন্ধুর হাসি মজার মিলনে সেও নেয় একটু খুশি, হৃদয়ের নিষ্পাপ মিলনের ছায়ায়।
এমনি করে কিছু দিন যাওয়ার পর মেয়েটি আর আসিলো না। রাখাল নিষ্পাপ ছলছল চোখে মাঠের পরে পশ্চিমে তাকিয়ে থাকে। যদি ছোটো অস্পষ্ট কোন ছবি স্পষ্ট হয়ে আসে তার নয়নে ছোঁয়া দিতে। কিন্তু নয়ন তো নয়নের অশ্রু জলে বন্দি থেকে যায়। অস্পষ্ট অস্পষ্টই থেকে যায়। সে ভেবে নেয় হয়তো এতোটুকুই ছিল এই বন্ধুত্বের কাল। আজ সে খুশি হয়েছে অন্য কোনও খুশির তরে। আজ তার এই রাখালের প্রয়োজন ফুরিয়েছে। আর নেই কোন লাভ তার তরে বসে থাকার বা তার পানে চেহে থাকার।
কিন্তু গাছ দেখিতে পায় অন্য এক ঘটনার দৃশ্য। সে যে উঁচু, বয়সে বড়, তার দৃষ্টি যায় মাঠ পেরিয়ে দূর ঐ গ্রামের কাঁচা রাস্তায়। যেথায় থাকে কত কথার সাক্ষী হয়ে। গাছ দেখতে পায় ছোট্ট মেয়েটির যন্ত্রণার ছবি।
বেজেছে দামামা। ব্যান্ডের দল বাজাচ্ছে ঢোল। পালকি চলেছে পথে, হয়তো অন্য কোন গ্রামের সন্ধানে। কিছু লোক পিছু চলেছে। কেউ কাঁদে, কেউ হাসে, কেউ নাচে, কেউ চলে এই অদ্ভুত মিশ্রণে। এ যে একে অপরের সম্পর্কের মিলনোৎসব। দুই অপরিণত প্রাণের জবরদস্তি মিলন। সমাজের আত্ম-হাসি আর দুটি প্রাণের আত্মগ্লানী। কিন্তু একি? এমন তো আগে হয়নি। এই অমিশ্রন যাত্রা বহুবার দেখেছে গাছ, কিন্তু আজ যে অন্য কিছু। গাছ আজ তার দুর্বলতার, না চলতে পাওয়ার বেদনায় মর্মাহত। আজ সে কশে সৃষ্টি কর্তাকে। যেখানে একটি পতঙ্গ চলতে পারে, একটু হলেও করতে পারে চেষ্টা কিছু করার, সেখানে গাছ যে কিনা জীবন সৃষ্টির ধারক হয়েছে পঙ্গু। এক পাও চলতে পারে না বলতে পারে না। কেমন এ জীবন। আজ তার মনে হয়, “আমি রই আর না রই কি তার ফরক। এ জীবন আর মৃত্যু দুই তো হয়েছে এক।
গাছের নির্মম এই বেদনায় পাতা করে জিজ্ঞাসা, “কি দেখলে গো? কেন এমন করো। ভুলো না তোমাতেই বাসে বাসা পক্ষীর দল। তোমার ফলেই চলে জীবন অভাগার। তোমার ছায়ায় কাটে দিন রাখালের। তোমার তরে আসে বর্ষা, রোখ বন্যা, গাঁথ উর্বর জমি, আছো তুমি আছে জীবন, নেই তুমি সবই হয়েছে অমিল”। গাছ বলে, “আজ আমি নিরুপায় দূরে যে দেখি এক অশ্রু-গামী নির্মম ঘটনা। হয়েছে যে বুকে ব্যথা, দেখেছি যে হতে পাপ করিনি তো তার নিবারণ। এক নিষ্পাপের বেদনার থেকেছি যে হয়ে সাক্ষী”। পাতা বলে, “কি দেখেছো বলো”। গাছ বলে, “পালকি থেকে ঐ ছোট মেয়েটি রাখালের বন্ধু পালাতে দিলো ছুট জঙ্গল তরে কাঁচা রাস্তায়। কোনও এক লোকের ছোড়া পাথরে পড়ল যে নিচে। কিছু লোক জোর করে নিয়ে যায় আবার পালকিতে। সে করে ক্রন্দন, করে আর্তনাদ। কিন্তু সবাই আজ বরই নির্মম, শোনে না কেউ তার বেদনা, দেয় যন্ত্রণা, তোলে হাত, করে জবরদস্তি, তারা সব নিয়েছে শপথ করবে তাকে গ্রাম ছাড়া, পাঠাবে কোনও পরলোকের পরে। এই রাখাল ভাবে ভুলিয়া গেল তারে। কিন্তু এই মূর্খকে বোঝাবে কে আজ এক দুর্বলের হল সত্যের পরীক্ষা। এই নিষ্ঠুর সমাজের হাতে হল সমর্পণ আরও এক নিষ্পাপ প্রাণের। এই রাখাল কি পারতো না বাঁচাতে তারে। একি শুধুই ভাগ্যের তরে আলসের বলে অভিমানের জালে বন্দি থেকে হারিয়ে দিল এক নিষ্পাপ ভালোবাসাকে। আজ এই ছোট্ট মেয়ের যন্ত্রণার কারণ হইলো নাকি এই মূর্খ রাখাল। আর আমি, এতো জ্ঞান এতো স্মৃতি এতো কথা কি বা করিলাম আমার ওই ছোট্ট বন্ধুর পরে”।
![]() |
| lost in inside made you live in hell, there is no escape |
এই দুঃখ্যের স্মৃতি ধীরে ধীরে ঝাপসা হতে থাকে। প্রাণবন্ত অন্তিম কালের হাসিও ধীরে ধীরে হারাতে থাকে। হঠাৎ এমনই এক দুপুরে হল কি! এ তো ওই মানুষ খেকো বাঘ। করিল হামলা রাখালের পরে। আজ ওই মেয়েটি কোথায় কে বা যানে। তবে তার শেখানো শিক্ষায় রাখাল উঠল মগডালে। বাঘ অতো উঁচুতে উঠতে না পেরে গর্জাতে গর্জাতে চলে গেল দূরে। বেঁচে গেল রাখাল। কিন্তু সে কি করবে আজ মেয়েটিকে খোঁজ। আজ সে মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরল ফিরে। শুনেছি দেবদাসও একবার পারুলকে দেখতে তার গ্রামে গিয়ে ছিল। কিন্তু এতো শরৎচন্দ্রের কাহিনী নয়, না তার সাহিত্য থেকে শিক্ষিত কোন পাঠকের কথা। রাখালের পড়িল না মনে মেয়েটির কথা। সে নিজেকে ধন্যবাদ দেয় গাছে চড়তে জানার জন্য। সে ভুলে গেছে গাছকেও যে তার মগডালে তাকে থাকতে দিল। ভেঙে ফেলল না এই বাঘের মুখে। কেন ফেললনা। এই রাখালই তো এক বাবুর সাথে মিলে এই গাছকে বধ করবে তাকে টুকরো টুকরো করবে। এটা কি গাছের মুর্খামি। এই খুনিকে দিল আশ্রয়। পাতার প্রশ্নে গাছ বলে, “রাখাল তার চরিত্রের পরিচয় তার কর্মে দেবে। আমি আমার দায়িত্ব কর্ম নৈতিকতার হাত ছাড়তে পারবো না। আমি যেমন ছিলাম তেমনই থাকব। এবার কাজ তাদেরই যারা আমায় দেখেছে। যারা আমায় মারবে তাদের ভালো হোক তাতেই ভালো। কাঠ কেটেই তো কত লোক পেট চালায়। তেমনই খুন চুরি বদ কাম করেও লোক পেট চালায়। তাদের কর্মই তাদের পথ দেখাবে। শুধু একটাই কথা, আমি আবারও আসিব ফিরে; নতুন গাছের রূপে। কিন্তু এই হারানো মানুষগুলো কি আর ফিরতে পারবে। শুধু ভয় একটাই, হয়ে না যাই আমরা একা। এ জীবন তো আমাদের উভয়ের মিলনের ফল। যেন বিধাতা রাখে এমন সর্বদাই।
কিন্তু বিধাতা কি? এ তো মানুষের জ্ঞান। মানুষ যদি জ্ঞানকে মূল্যহীন ভাবে তো কে কি করবে। একদিন এর পরিণাম আসবে সমাজের বুকে, আজ তা রাখালের জীবনে।
কিছুদিন পর রাখাল দেখে কিছু লোক এই গাছটিকে কাটছে। সে এসে শুধরয়, “কি হল”? লোক গুলো বলে তারা বাবুর লোক, গাছ কাটছে। রাখাল বলে, “গাছ কাটছ, তো ফ্যাক্টরি হল”? লোকগুলো বলে, “দেরি আছে”। তো রাখাল বলে, “এখানে বাঘ আসে। এই গাছে চড়ে আমি বেঁচেছি”। লোকগুলো তাকে কয়েক হাজার টাকা দিয়ে বলে, “এই গাছটার খুব দাম আছে, তাই বাবু পাঠাল। তুমি তো অন্য গাছেও চড়তে পারবে”। রাখাল ভাবল হ্যাঁ তাই তো, আরও গাছ আছে। আর পয়সাও সে পেল, তো খুব খুশী। বলল, “ঠিক আছে”।
এখন আর আম গাছটা নেই। দূরে ওই গাছের এক পাতা পরে থাকল সবার অলক্ষণে। সেই দেখে গেল দুর্বলতার পরিহাস। সে দেখল পরিশ্রম না করা, কারোর জন্য কিছু না করার, অল্প পয়সার প্রতি লোভ, অসাড়ের স্বপ্ন, শোনা কথায় বিশ্বাস, লোককে ভ্রান্ত ভয় দেখানোর পাপের পরিণাম। এই মূর্খ লোভী পরিশ্রম বিহীন রাখালের বিধাতার বিচার।
সেই মেয়েটি এসেছে আজ। রাখাল আজ অন্য গাছের তলায় আশ্রিত। মিলিয়েছে চোখ। মেয়েটি খোঁজে তার হারানো বন্ধুকে ছলছল চোখে। তার এক হাতে বেঁধেছে ভগ্ন চুরির দাগ,আর এক হাতে একটু দইয়ের ভাঁড়। চোখে অশ্রুর মেঘ, চুল হয়েছে ঝাঁকড়া। যেন কতদিন করেনি স্নান। লাগে দুর্বল, লাগে এসেছে পালিয়ে সব কিছু ছিন্ন করে কিংবা কোন শিকারের হাত থেকে পালিয়েছে। কিন্তু তার বন্ধু ভুলিয়েছে সব। নেই গাছ নেই তার ঠিকানা। দু হাঁটুতে পরল বসিয়া। করিতে চায় চিৎকার, কিন্তু তার স্বর যে বেরিয়ে পৌছয় না কানে। কি করে এই মুখ্যর কানে যাবে যে এসেছে তার প্রাণ প্রাণের তরে। ক্রন্দনরত চোখ ঝিমিয়ে আসে, শরীর অসাড় হয়, মাটি তাকে টেনে নেয় কাছে। কিছু লোক এসে নিয়ে যায় তাকে। থেকে যায় এক ধারে ছোট্ট ভাঁড়ে একটুকু দই যাতে ছিল অশেষ ভালোবাসা, শুধুই নিষ্পাপ এক ভালোবাসা।
আজ ঐ পাতাটিও করতে চায় চিৎকার, বলতে চায় রাখালকে এসেছে এসেছে সে এসেছি। কিন্তু হায় বোবা দুনিয়ায় শব্দই যে হল এক তরঙ্গ যা বলতে পারে, পৌঁছতে পারে কারোর কানে। হৃদয়ের কথা, মনের কথা, সব যে আজ সাহিত্যের উপমা ছাড়া আর কিছুই নয়। পাতাও আজ ভাবে ভালোই হল, চললাম এসব যন্ত্রণার থেকে, হল ছুটি। বলে, “গাছ, আজ তুমি নেই খুশি। এই পাপী ধরণীর বুকে এক পাপের হাত থেকে হয়েছ তুমি মুক্ত”। রাখালের কাছে থেকে গেল মেয়েটি স্বার্থ লোভী বন্ধু হয়ে যে করে না তাকে মনে। পাতার কাছে আজ প্রশ্ন একটাই, মেয়েটার হল কি! ফিরবে তো আবার, না এখানেই শেষ হল এক নিষ্পাপ প্রাণের আত্মকাহিনী।
![]() |
| may be the last sunset, which will write an unknown tomorrow |
ভালোবাসার বিহনের পর দিন কাটে শুধু অন্তিমার্থে। কখন হবে শেষ। রাখালের চোখে এখন একটাই ছবি, বাবু কবে দেবে তার ফ্যাক্টরিতে চাকরি। স্বপ্ন স্বপ্নই থাকে যদি সে স্বপ্নের বোঝা অন্যের ঘাড়ে চাপায়। আজও তাই। এলো মানুষ খেকো বাঘ। রাখাল ভাগল। উঠল একটা বড় বট গাছে। কিন্তু এ গাছ তো রাখালের বন্ধু নয়, রাখালও নয় তার বন্ধু। তো জানবে কি করে গাছের কোথায় নিরাপদ। ঠিক বাঘটি ঝুলি ধরে উঠে রাখালকে ধরল। দূরে শুকনো হতে থাকা আম পাতা দেখে গেলো আরও নিদারুণ সত্য। খণ্ডিত রক্তাক্ত রাখালের পরে বাবু মারল বাঘকে। নিয়ে গেল বাঘ, আর লোকেরা নিয়ে গেল আধখন্ড রাখালের দেহবসেস। আত্মারূপি রাখাল হাসিল মৃদু হেসে। পাতা দেখিতে পায় এই আত্মাকে। বলে, “তুমি আমার কথা শুনতে পাও”। রাখাল বলে, “আজ সব শুনতে পাই, সব দেখতে পাই, শুধু করতে পারিনা। যখন করতে পারতাম তখন শুনতে চাইনি, দেখতে চাইনি, শুধু পেতে চেয়েছিলাম। আজ আমরা এক সাথী দুই বন্ধু”। পাতা হেসে বলে, “না গো আমি তোমার সাথী বন্ধু নই। কেননা বন্ধু হলে ছেড়ে যেতাম না, ভুলে যেতাম না। কিন্তু আমি বসন্তের শেষে কোন এক বেলা হারিয়ে যাব মিলিয়ে যাবো, তুমি থেকে যাবে আমরণ একাকী হয়ে। তবে যতদিন আছি থেকো এথায় কাটাব দিন, আর কইব কি না করতে পারতাম স্মৃতিচরনার্থে।
আজ সব শেষ। দুই সাথী হারিয়ে যাবে। পাতা আজ মিলিয়ে যাবে। কালের ভোরে আর রাঙা হবে না এই শুকনো আম পাতা। কিন্তু রাখালের আত্মা থেকে যাবে আরও কিছু নির্মম হতে দেখতে দিনে দিনে। জেনে যাবে দেখে যাবে আরও কিছু সত্য যা একদিন দেখেছিল ঐ আম গাছ। আজ তার দুর্বলতার পরিহাস। আজ তার লোভ, মুর্খামি, বোকামি, বন্ধুত্বর তরে বন্ধুত্ব না নিভানোর পরিহাস। গাছ বিহীন সমাজের, প্রাণ বিহীন জীবের, ভালোবাসা বিহীন সমাজের সূচনা। আমরা কি এমনি এক ভবিষ্যতের জন্য চলেছি যেথায় আছে শুধুই “দুর্বলতার পরিহাস”।।
![]() |
| “দুর্বলতার পরিহাস” - A World Of Weakness, Cowardliness, Laziness Will Rise With An Unknown Sickness...
By shayaranapan |





Comments
Post a Comment